পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া

আপনি কি পিল খান, আর মাসিকের ডেট নিয়ে চিন্তায় আছেন? পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নিশ্চয়ই! চিন্তা নেই, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব। পিল খেলে কেন মাসিক হয় না, কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, এবং এই নিয়ে আপনার মনে যা কিছু প্রশ্ন আছে, সব কিছুর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়ার কারণ

পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তবে এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। চলুন, কারণগুলো একটু বিস্তারিত জেনে নেই:

হরমোনের তারতম্য

পিলগুলোতে মূলত ইস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রোজেস্টেরন (Progesterone) হরমোন থাকে। এই হরমোনগুলো আপনার শরীরের স্বাভাবিক হরমোন চক্রে প্রভাব ফেলে। পিল খাওয়ার ফলে অনেক সময় জরায়ুর ভেতরের দেয়াল (Endometrium) পুরু হতে পারে না, যার কারণে মাসিকের সময় রক্তপাত কম হয় বা একেবারেই হয় না।

পিলের প্রকারভেদ

বাজারে বিভিন্ন ধরনের পিল পাওয়া যায়। কোনোটাতে হরমোনের মাত্রা বেশি, আবার কোনোটাতে কম। যে পিলে হরমোনের মাত্রা কম থাকে, সে ক্ষেত্রে মাসিক না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে “মিনি পিল”-এর (Mini Pill) ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়, যেগুলোতে শুধু প্রোজেস্টেরন থাকে।

নিয়মিত পিল না খাওয়া

পিল খাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটা প্রতিদিন একই সময়ে খেতে হয়। যদি আপনি একদিনও পিল খেতে ভুলে যান, তাহলে আপনার শরীরে হরমোনের মাত্রা কমে যেতে পারে এবং এর ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

অন্যান্য ওষুধ

আপনি যদি অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাহলে পিলের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics) বা ব্যথানাশক ওষুধ পিলের হরমোন শোষণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়।

শারীরিক ও মানসিক চাপ

অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা মানসিক চাপের কারণেও আপনার মাসিক চক্রে পরিবর্তন আসতে পারে। স্ট্রেসের কারণে আপনার শরীরের হরমোনগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে, যার ফলে পিল খাওয়া সত্ত্বেও মাসিক নাও হতে পারে।

পিল খাওয়ার কত দিন পর মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?

সাধারণত, পিল খাওয়া শেষ করার ২-৪ দিনের মধ্যে মাসিক হওয়ার কথা। কিন্তু এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে একটু বেশি সময়ও লাগতে পারে। যদি পিল বন্ধ করার এক সপ্তাহের বেশি সময় হয়ে যায়, তবুও মাসিক না হয়, তাহলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করানো ভালো।

যদি মাসিক না হয়, তাহলে কি আমি গর্ভবতী?

পিল খান, অথচ মাসিক হচ্ছে না—এমন অবস্থায় গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও পিল ঠিকমতো খেলে গর্ভবতী হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, তবুও কিছু কারণে পিলের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। তাই মাসিক মিস করলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করানো উচিত।

Read More  বেতন মওকুফের জন্য আবেদন

পিল খাওয়া বন্ধ করলে মাসিক না হওয়ার কারণ

অনেক নারী পিল খাওয়া বন্ধ করার পর মাসিকের সমস্যায় পড়েন। এর কিছু কারণ আলোচনা করা হলো:

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

দীর্ঘদিন ধরে পিল খাওয়ার কারণে আপনার শরীরের স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদনে পরিবর্তন আসে। পিল বন্ধ করার পর শরীরকে আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগে। এই সময়টাতে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।

ওভারিয়ান সিস্ট (Ovarian Cyst)

পিল খাওয়া বন্ধ করার পর অনেক নারীই ওভারিয়ান সিস্টের সমস্যায় পড়েন। এই সিস্টগুলো সাধারণত ডিম্বাশয়ে তৈরি হয় এবং হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা মাসিক চক্রে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অনেক সময় মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়, আবার কখনও একেবারে বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তাই পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া একাধিক কারণে হতে পারে, যার মধ্যে ওভারিয়ান সিস্ট একটি সাধারণ কারণ। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

থাইরয়েড সমস্যা

থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের দেহের মেটাবলিজম ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে শরীরের হরমোন ব্যালান্সে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে নারীদের মাসিক চক্রের ওপরও। অনেক সময় মাসিক দেরিতে হয় বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে থাইরয়েড সমস্যাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। তাই সময়মতো পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পিসিওএস (PCOS)

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) হরমোনজনিত একটি সমস্যা, যা নারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এই অবস্থায় ডিম্বাশয়ে একাধিক সিস্ট তৈরি হয়, যা হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্য সংকট সৃষ্টি করে। কারণেই মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে পড়ে, দেরিতে বা সম্পূর্ণ বন্ধও হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে PCOS এর প্রভাব আরও প্রবল হয়। হাই স্টেরয়েড হরমোন লেভেল ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে ওজন বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত কিছু লক্ষণও দেখা যায়। 

এছাড়া ওজন বাড়ার সাথে সাথে মুখমণ্ডলে অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধি, চর্মরোগ এবং ত্বকের অম্লবৃদ্ধির মতো লক্ষণও থাকতে পারে। PCOS নিশ্চিত করতে গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েট, লাইফস্টাইল পরিবর্তন ও চিকিৎসা মিলে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এই সমস্যা।

Read More  ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম | ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস কমান

পিল খাওয়ার সময় মাসিক না হলে করনীয়

পিল খাওয়ার সময় মাসিক না হলে আপনি কী করতে পারেন, তার একটা গাইডলাইন নিচে দেওয়া হলো:

ধৈর্য ধরুন

নিশ্চয়ই, পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা একেবারে স্বাভাবিক। প্রথমে, পিল খাওয়ার কয়েকটি মাসে শরীর নতুন হরমোনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নেয়, ফলে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া একধরণের সাময়িক সমস্যা হতে পারে, যা সাধারণত কিছু সময়ের মধ্যে নিজে থেকেই স্বাভাবিক হয়ে আসে।

তবে, দীর্ঘ সময় ধরে যদি এই সমস্যা থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। হরমোনের পরিবর্তন এবং মাসিক চক্রে অস্থিরতা মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে, সুতরাং এর সঠিক নিরীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়মিত পিল খান

পিল খাওয়ার সময় ঠিক রাখতে মনোযোগী থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া এড়াতে, প্রতিদিন একই সময়ে পিল খাওয়া উচিত। এটি শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। অনেকেই সময়মতো পিল খেতে ভুলে যান, তাই একটি অ্যালার্ম সেট করে রাখা যেতে পারে, যাতে সময়মতো পিল খাওয়া নিশ্চিত হয়।

এতে আপনি আপনার মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলোর ঝুঁকি কমবে। নিয়মিত পিল খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী এবং মাসিকের অনিয়মিতা রোধে সাহায্য করবে।

মেডিক্যাল পরামর্শ

যদি তিন মাস পার হয়ে যাওয়ার পরেও মাসিক না হয়, তাহলে অবশ্যই একজন গাইনিকোলজিস্টের (Gynecologist) পরামর্শ নিন। তিনি আপনার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?

কিছু লক্ষণ দেখলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  • পিল খাওয়া শুরু করার তিন মাস পরেও মাসিক না হলে।
  • পেটে অতিরিক্ত ব্যথা বা অস্বস্তি হলে।
  • অতিরিক্ত দুর্বল লাগলে বা মাথা ঘুরলে।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলে।
  • প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হলে।

পিল নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)

এখানে পিল খাওয়া নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের মনে প্রায়ই আসে:

পিল খেলে কি ওজন বাড়ে?

অনেক নারীর মনে এই প্রশ্নটা থাকে। পিলের কারণে ওজন বাড়তে পারে, তবে এটা সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়। কিছু পিলে থাকা হরমোনের কারণে শরীরে পানি জমতে পারে, যার ফলে ওজন সামান্য বাড়তে পারে। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

Read More  শিশুর স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল(Strategies To Overcome Children's School Phobia)

পিল কি সবসময় নিরাপদ?

পিল সাধারণত নিরাপদ, তবে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, তাদের পিল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

পিল কি বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে?

এটা একটা ভুল ধারণা। পিল খেলে বন্ধ্যত্ব হয় না। পিল বন্ধ করার পর বেশিরভাগ নারীই খুব সহজে গর্ভধারণ করতে পারেন।

পিল খাওয়ার সময় কি অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে?

কিছু ওষুধ পিলের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। তাই পিল খাওয়ার সময় অন্য কোনো ওষুধ খেতে হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

পিল কিভাবে কাজ করে?

পিল মূলত ডিম্বাণু নিঃসরণ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে শুক্রাণু ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, এবং গর্ভধারণ প্রতিরোধ করা যায়।

পিল খাওয়া বন্ধ করলে হতে পারে যেসব সমস্যা

পিল খাওয়া বন্ধ করলে আপনার শরীরে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। নিচে কয়েকটি সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

  • মাসিক অনিয়মিত হওয়া: পিল বন্ধ করার পর কয়েক মাস মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। শরীরকে স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদনে ফিরতে কিছুটা সময় লাগে।
  • ত্বকের সমস্যা: অনেকের ক্ষেত্রে ব্রণ বা অ্যাকনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • মেজাজের পরিবর্তন: হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মেজাজ খিটখিটে হতে পারে বা মানসিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
  • চুল পড়া: কিছু নারীর ক্ষেত্রে চুল পড়ার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

মাসিক নিয়মিত রাখার ঘরোয়া উপায়

পিল খাওয়ার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় আছে, যা আপনার মাসিক নিয়মিত রাখতে সাহায্য করতে পারে:

আদা

আদা মাসিকের ব্যথা কমাতে এবং মাসিক নিয়মিত করতে খুবই কার্যকরী। প্রতিদিন সকালে আদা চা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

দারুচিনি

দারুচিনিতে থাকা উপাদানগুলো হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করে।

অ্যালোভেরা

অ্যালোভেরা জুস খেলে হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং মাসিক নিয়মিত হয়।

ভিটামিন সি

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন – লেবু, কমলা, পেয়ারা ইত্যাদি খেলে মাসিক নিয়মিত হতে পারে।

ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের হরমোনগুলো সঠিক থাকে এবং মাসিক নিয়মিত হয়। যোগা ও মেডিটেশনও এক্ষেত্রে খুব উপকারী।

শেষ কথা

পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়া নিয়ে চিন্তা না করে, প্রথমে কারণগুলো জানার চেষ্টা করুন। অনেক সময় এটা স্বাভাবিক হলেও, কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!

আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনার জন্য উপকারী ছিল। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোনো সমস্যায় আমরা সবসময় পাশে আছি।

Leave a Comment