আমাদের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ঘুম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ও আরামদায়ক ঘুম আমাদেরকে সক্রিয় ও সতেজ করে তোলে। সাধারণভাবে স্বাস্থ্যকর ঘুম বলতে প্রতি রাতে একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুমকে বুঝানো হয়। একে অনেকে ঘুমের পরিমাণ হিসাবে ধরে নেয়। যদিও ঘুমের পরিমাণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি ভালো ঘুমের জন্য এর পরিমাণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো গুণগত মান। নিয়মিত আরামদায়ক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুম আমাদের সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন রাজধানীর ইনজিনিয়াস পালমো ফিটের স্লিপ কনস্যালট্যান্ট ডা. ফাতেমা ইয়াসমিন
ঘুমের পরিমাণ কী? (What Is The Amount Of Sleep?)
ঘুমের পরিমাণ বলতে বোঝায় আপনি প্রতি রাতে কত ঘণ্টা ঘুমান। বয়সভেদে মানুষের ঘুমের সময় তারতম্য হয়।
* বয়স : ঘুমের চাহিদা (২৪ ঘণ্টায়)
* নবজাতক (০-৩ মাস) : ১৪-১৭ ঘণ্টা
* শিশু (৪-১২ মাস) : ১২-১৬ ঘণ্টা
* বাচ্চা (১-২ বছর) : ১১-১৪ ঘণ্টা
* প্রি-স্কুল (৩-৫ বছর) : ১০-১৩ ঘণ্টা
* স্কুল বয়সের শিশু (৬-১২ বছর) : ৯-১২ ঘণ্টা
* কিশোর (১৩-১৮ বছর) : ৮-১০ ঘণ্টা
* প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬৪ বছর) : প্রতি রাতে ৭-৯ ঘণ্টা
* প্রাপ্তবয়স্ক (৬৫+ বছর) : প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা
এটি একটি সাধারণ নির্দেশিকা করা হয়েছে। এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের তাদের বয়সের জন্য প্রস্তাবিত পরিমাণের চেয়ে বেশি বা কম ঘুমের প্রয়োজন। এমনকি কিছু নিয়মের ব্যতিক্রমগুলো বিবেচনা করেও এমন অনেক লোক রয়েছে যারা নিয়মিত তাদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘুমায় না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৭০ মিলিয়ন আমেরিকানরা কোনো না কোনো ধরনের ঘুমের রোগে ভুগছেন এবং প্রায় ৩৫ শতাংশ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্করা প্রতি রাতে প্রয়োজনীয় সাত ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমায়। অপর্যাপ্ত ঘুমে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং জটিল রোগের ঝুঁকিগুলোও দেখা যায়। অপর্যাপ্ত ঘুমের প্রভাব আমাদের মস্তিষ্কের উপর সরাসরি পড়ে।
হার্ভার্ড মেডিকেলের গবেষণায় দেখা গেছে যারা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমান তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে আমাদের শরীরে কর্টিসল নামক একটি হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে আমাদের উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজের উপর। অপর্যাপ্ত ঘুমের প্রভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং দ্রুত মুড পরিবর্তন হয়।
ঘুমের গুণগত মান কী (What Is Sleep Quality?)
ঘুমের গুণমান বলতে বোঝায় আপনি কতটা ভালো ঘুমান।
সঠিক মানের ঘুমের জন্য রয়েছে ৫টি উপকরণ (There Are 5 Ingredients For Good Quality Sleep)
* ঘুমিয়ে পড়ার সময় : আপনি কত দ্রুত এবং কত সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ বিছানায় যাওয়ার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে সক্ষম হয়।
* ঘুমের ধারাবাহিকতা বজায় : একবার ঘুমিয়ে পড়লে একটানা আপনার ঘুমিয়ে থাকার ক্ষমতা। ভালো মানের ঘুম হয় ক্রমাগত, রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায় না।
* ঘুমের কার্যকারিতা : ঘুমের কার্যকারিতা মানে আপনি কতটা সময় ঘুমিয়েছেন বনাম আপনি কতটা সময় ঘুমানোর জন্য বিছানায় কাটিয়েছেন। সঠিক মানের ঘুমের জন্য ঘুমের কার্যকারিতা মোট সময়ের অন্তত ৮৫ শতাংশ মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়।
* ঘুমের সময় : ঘুমের সময় বলতে বোঝায় যখন প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুমানো। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি নির্দেশ করে প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো এবং জেগে ওঠা।
* ঘুমের তৃপ্তি : ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ লাগা ও সারা দিন উদ্যমী থাকা। এভাবে ঘুমের পরিতৃপ্তি পরিমাপ করা হয়।
খারাপ মানের ঘুমের ক্ষতি কী? (What Are The Harms Of Poor Quality Sleep?)
খারাপ মানের ঘুমের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উভয় ক্ষেত্রেই গুরুতর স্বাস্থ্য ঘাটতি দেখা যায়। যেমন-কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, ভুলে যাওয়া প্রবণতা, মনোযোগ কমে যাওয়া, মানসিক চাপ বৃদ্ধি, বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ দেখা দেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠতে সমস্যা হচ্ছে অথবা খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে ওঠা, সারা দিন ক্লান্তি ভাব থাকা, দিনের বেলা ঘুমানো, দিনে অনেক বেশি ঘুমানো। এ ছাড়া ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কলস্টেরল, হৃদরোগ এবং স্ট্রোক হয়।
রাতের আরামদায়ক ঘুমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ঘুমের কিছু চিহ্ন আছে। যেমন-
* সকালে ঘুম থেকে উঠেই সতেজ অনুভূতি
* সারা দিন সতেজ থাকা
* ভালো মেজাজে থাকা
* পরিষ্কার-মাথা অনুভব করা
কীভাবে ঘুমের পরিমাণ এবং গুণগত মান উন্নত করা যায়? (How To Improve The Quantity And Quality Of Sleep?)
ভালো ও স্বাস্থ্যকর ঘুম পেতে আপনি যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন তার মধ্যে রয়েছে-
* ঘুমের সমস্যা নির্ণয় করা : আপনি যদি মনে করেন যে আপনার ঘুমের সমস্যা আছে যা আপনার ঘুমকে প্রভাবিত করছে, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
* জীবনযাত্রায় পরিবর্তন করুন : যদিও আপনার জীবনের কিছু অংশ অন্যদের তুলনায় পরিবর্তন করা কঠিন হতে পারে, আপনি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন যা সম্ভবত আপনার ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে এবং আপনার ঘুমকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারে। যেমন-নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান, অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন বাদ দিন।
* ঘুমের পরিবেশ নিশ্চিত করুন : বেশিরভাগ লোক তাদের ঘুমের পরিবেশের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করেন। যদিও প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ রয়েছে, মানুষ সাধারণত অন্ধকার, শান্ত, আরামদায়ক পরিবেশে ঘুমাতে পছন্দ করে।
* ফোন ও ট্যাব বন্ধ : গবেষণায় দেখা গেছে শোওয়ার সময় ফোনের ব্যবহার ঘুমের ব্যাঘাত হয়। বিছানায় ফোন এবং অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করায়, ঘুমের সময়ের গতি হারাতে পারেন এবং আপনার প্রকৃত শোওয়ার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে দেরি হতে পারে।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস কীভাবে প্রয়োগ করবেন তা আপনি নিশ্চিত না হলে, আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
ভালো ঘুমের জন্য যা করণীয় (What To Do For Better Sleep) – Somokal
ভালো ঘুমের জন্য যা প্রয়োজন সময় মতো ঘুমানো , যা আপনার মন কে সব সময় সতেজ রাখবে। শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। ভালো ঘুম না হলে শরীরের পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতাও দেখা দেয়। এ কারণে প্রতিদিন অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেকের অনিদ্রার সমস্যায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে ভালো ঘুমের জন্য তারা কিছু বিষয় অনুসরণ করতে পারেন। যেমন-
ফোন বন্ধ করে ঘুমানো (Turn off the phone and sleep): ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘন্টা আগে টিভি, কম্পিউটার এবং নীল রশ্মি ছড়ায় এমন ডিভাইসগুলো বন্ধ রাখলে ঘুম ভালো হবে।
বিশ্রাম নেওয়া (To Rest) : দিনের বেলা বিশ্রাম নিলেও তা ২০ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত নয়।
ঘড়ি বন্ধ করে ঘুমানো (Sleep off the clock) : পরের দিন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে ভেবে অনেকের ঘুম আসে না। এমন হলে অ্যালার্ম ঘড়িটি ড্রয়ারে বা খাটের নিচে রেখে দিন।
কোলবালিশ ব্যবহার করা (Using charcoal) : ব্যাক পেইন গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ব্যাক পেইন থাকলে কোলবালিশ ব্যবহার করা উচিত।
কাঁধ স্বাভাবিক রাখা (Keep the shoulders normal) : ভালো ঘুমের জন্য সঠিক বালিশ বাছাই করা জরুরি। বালিশ যেন বেশি পুরুও না হয়, আবার পাতলা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। পেটে ভর দিয়ে কখনো ঘুমানো উচিত নয়। এতে ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
বায়োলজিকাল ক্লক (Biological clock) : প্রতিদিন নিয়ম করে একই সময়ে ঘুমাতে যান, ও ঘুম থেকে উঠুন। ছুটির দিনগুলোতেও একই কাজ করুন। ঘুম থেকে উঠার পর ৫ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য সূর্যের আলোতে যাওয়া উচিত।
ক্যাফেইন (Caffeine): বিকালের পরে ক্যাফেইন গ্রহণ করা উচিত নয়। চকলেটে থাকা অল্প পরিমাণ ক্যাফেইনও রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
ব্যায়াম (Exercise): নিয়মিত ব্যায়াম করলে ঘুম ভালো হয়। তবে ঘুমাতে যাওয়ার ৩-৪ ঘন্টা আগে ব্যায়াম শেষ করা উচিত।
রাতের খাবার (Dinner): বেশি রাতে ভারি কোনো খাবার না খাওয়াই ভালো। সন্ধ্যায় হালকা স্ন্যাক খাওয়া উচিত, যা ভালো ঘুম হতে সাহায্য করবে।
আলো কমিয়ে ঘুমানো (Sleep dimly): ঘুমাতে যাওয়ার ২-৩ ঘণ্টা আগে রুমের আলো কমিয়ে রাখুন। কম আলো মস্তিষ্ককে মেলাটোনিন হরমোন তৈরি করার জন্য সংকেত দেয়। এই হরমোন ঘুমের সহায়ক।
মনকে মুক্ত করুন (Free the mind): ঘুমানোর আগে কোনো কঠিন বা বড় কাজ করা উচিত নয়। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ভালো ঘুমের জন্য ঘুমানোর আগে বই পড়া বা মেডিটেশনের অভ্যাস করা উচিত।
আরও পড়ুন : পায়ের মাংসপেশিতে টান লাগলে করণীয় (What to do if the leg muscles are tight)
মাথা ব্যথা দূর করার ঘরোয়া উপায় (Home remedies for headache)